
সম্পাদক
৪ নভেম্বর রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ড। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের ব্যবহূত রবি নম্বরের সর্বশেষ টাওয়ার লোকেশন উল্লিখিত সময়ে ছিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া এলাকার চনপাড়া। এরপর থেকে তাঁর ফোন আর সচল পাওয়া যায়নি। ফারদিন হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
ফারদিন হত্যা মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করলেও ছায়া তদন্ত করছে একাধিক সংস্থা। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ওই রাতে ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকা, জিনজিরা ও বাবুবাজার ব্রিজ এলাকা ঘুরে কেন, কী কারণে ফারদিন চনপাড়া গিয়েছিলেন, তার হিসাব মেলানোর চেষ্টা চলছে। স্বেচ্ছায় নাকি ফাঁদে পড়ে তিনি সেখানে যান- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ৪ নভেম্বর বিকেলে ডেমরার বাসা থেকে বুয়েটের উদ্দেশে বের হন ফারদিন। পরদিন তাঁর পরীক্ষা ছিল। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে ৫ নভেম্বর পরিবার রামপুরা থানায় জিডি করে। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর বিকেলে তাঁর লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
ফারদিনের নিখোঁজের তথ্য জানার পরপরই তদন্ত শুরু করে রামপুরা থানা পুলিশ। ডিবি বা র্যাব তদন্ত শুরুর আগেই ফারদিনের মোবাইল ফোনের গতিবিধি পর্যালোচনা করে দেখে তারা। ওই তদন্তেও এসেছে, ফারদিনের ব্যবহূত মোবাইল নম্বরের সর্বশেষ অবস্থান ছিল চনপাড়া।
এ বিষয়ে গতকাল শনিবার পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি হায়াতুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, ‘যে কোনো নিখোঁজের ঘটনায় জিডির পর তদন্তে কিছু বিষয় আমরা অনুসরণ করি। প্রথমে আশপাশের থানায় ওই নামে কেউ আটক বা গ্রেপ্তার রয়েছে কিনা খোঁজ নিই। হতাহত অবস্থায় হাসপাতালে আছে কিনা তা জানার চেষ্টা হয়। এরপর মোবাইল ফোনের গতিবিধি ও সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্নেষণ করে দেখা হয়। জিডির পরই ফারদিনের নিখোঁজের বিষয় আমরা জানতে পারি এবং বুয়েটের ছাত্র হওয়ায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। বাদীকে নিয়েও আমরা অনেক জায়গায় সন্ধান করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ ৭ নভেম্বর ফারদিনের লাশ পাওয়ার খবর পাই। এর মধ্যেই প্রযুক্তিগত তদন্ত চলতে থাকে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, রামপুরা, কেরানীগঞ্জ, জনসন রোড ও চনপাড়ায় তাঁর উপস্থিতির তথ্য আমরা পেয়েছিলাম। লাশ উদ্ধারের পরপরই চনপাড়ায় পুলিশের একটি টিম তদন্তে গেছে। সেখানে সহকারী পুলিশ সুপারকেও পাঠানো হয়।
তদন্তের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ফারদিনের সর্বশেষ অবস্থান চনপাড়ায় জানতে পেরে ওই বস্তিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝিদের বক্তব্য নেন। জানা ও বোঝার চেষ্টা করেন আসলে কী ঘটতে পারে। নদীর জোয়ার-ভাটার হিসাব পর্যালোচনা করে এটা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন, ঠিক কোন জায়গায় পড়লে লাশ কতদূর যেতে পারে? এরপর মামলাটি ডিবিতে চলে যাওয়ায় ওই তদন্ত কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
এখন ডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে এ মামলা তদন্ত করছে। ছায়া তদন্ত করছে আরও একাধিক সংস্থা। র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চনপাড়াকেন্দ্রিক মাদক গ্যাং গ্রুপের হাতে ফারদিন খুন হয়েছে। প্রযুক্তিগত তদন্তে উঠে এসেছে, নিখোঁজের দিন ফারদিন তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে ধানমন্ডি, নীলক্ষেত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা ঘুরে রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজে যান। সেখানে বান্ধবীকে নামিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে কেরানীগঞ্জের জিনজিরায় যান। রাত ১০টা ৫৩ মিনিটে ফারদিনের অবস্থান ছিল বাবুবাজার।
মোবাইল ফোন ঘিরে প্রযুক্তিগত তদন্ত বলছে, রাত ১১টা ৯ মিনিটে পুরান ঢাকার জনসন রোড, ১২টা ৫০ মিনিটে গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট ও ২টার দিকে ফারদিনের অবস্থান ছিল যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচায়।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ২টা ৩ মিনিটে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা থেকে লেগুনায় ওঠেন ফারদিন। ওই সময় লেগুনায় আরও চার যাত্রী ছিলেন। ২টা ১৩ মিনিটে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার মোড় থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চারজনের সঙ্গে ওঠেন। ২টা ২৩ মিনিটে চনপাড়া যান। আর সর্বশেষ রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে তাঁর মোবাইল ফোন চনপাড়ায় সচল ছিল। কেন পরীক্ষার আগের রাতে এতগুলো জায়গা ঘোরেন ফারদিন, এ রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে একাধিক সংস্থা। তবে গতকাল যোগযোগ করা হলে ডিবির কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।