সমাজে বৈষম্য কমানোর প্রধান উপায় হতে পারে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো। সব করযোগ্য ব্যক্তি আয়কর স্তর অনুযায়ী কর দিলে জিডিপির অনুপাতে ব্যক্তি আয়কর বর্তমানের ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশে নেওয়া সম্ভব। এ জন্য নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কর অব্যাহতি সুবিধা বাদ দিলে প্রত্যক্ষ কর আরও বাড়ানো যেতে পারে।
শনিবার ‘বৈষম্য মোকাবিলা ও রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রত্যক্ষ কর প্রয়োগ’ শীর্ষক সেমিনারে এমন পর্যালোচনা উঠে এসেছে। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)। র্যাপিড রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে যৌথভাবে এর আয়োজন করে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশ, যা সারাবিশ্বে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। এর বড় কারণ প্রত্যক্ষ কর অনেক কম। বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ এবং প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ। সরকার প্রত্যক্ষ কর ৭০ শতাংশ ও পরোক্ষ কর ৩০ শতাংশে আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সঠিক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দুটি সমস্যা হলো- ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং সরকারি ব্যয় জিডিপির অংশ হিসেবে অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক কম। এর বড় কারণ প্রত্যক্ষ কর আহরণ কম। ভারত, ভুটান, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে জিডিপির অনুপাতে প্রত্যক্ষ কর থেকে আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যদিও দেশের গরিব মানুষ তাদের আয়ের অনুপাতে অনেক বেশি ভ্যাট দেয়।
র্যাপিড চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে করের আওতা অনেক কম। টিআইএনধারীর সংখ্যা ৭৬ লাখ থাকলেও ২৪ লাখ রিটার্ন দাখিল করছেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই নামমাত্র কর দেন। তিনি মনে করেন, ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে দিতে পারে সরকার। কারণ বর্তমানে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। করমুক্ত সীমা বাড়ালে এর ওপরে থাকা সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে পারলে জিডিপির অনুপাতে ব্যক্তি আয়কর ৩ শতাংশের বেশি নেওয়া সম্ভব। আবার করপোরেট কর জিডিপির অনুপাতে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ২ লাখ ৭৩ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ বা ৩০ হাজারের মতো কোম্পানি কর দেয়। এ ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। আর অনেকের সম্পদ থাকলেও মাত্র ১৫ হাজার লোক সম্পদের সারচার্জ দেয়। এটি বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, করের আওতা বাড়ানোর এমন একটি পদ্ধতি আনতে হবে, যা কাজে দেবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে সামাজিক বীমা নম্বর চালু করলে আয়-ব্যয়সহ করের হিসাব রাখা সহজ হবে। এতে কর আদায় বাড়াবে।
রাজ্জাক বলেন, যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাঁরা কম দেন। সরকার অনেক খাত থেকে কর পাচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রায় ৮০ ভাগ কর্মী কাজ করে। তাদের অনেকের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও করের আওতার বাইরে আছে। এ ছাড়া অনেক খাতেই কর অব্যাহতি দেওয়া আছে। এসব অব্যাহতির তেমন কাজে আসছে না। এসব অব্যাহতি তুলে দিয়ে রাজস্ব আয় বাড়িয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে ব্যয় বাড়ানো যাবে। এতে বৈষম্য কমবে। তিনি করনীতি ও কর প্রশাসন আলাদা করার সুপারিশ করেন। করনীতি বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো উচিত। তবে ৭০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। কারণ এনবিআরের কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে এনবিআর রাজস্ব আয়ে পিছিয়ে আছে। রাজস্ব আয় বাড়াতে এখন বড় বাধা রাজনৈতিক অর্থনীতি। কারণ অনেক খাতেই কর অবকাশ সুবিধা দিতে হচ্ছে। বিশেষ কর হার আরোপ করতে হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের অনেকেই ব্যবসায়ী হওয়ায় তাঁরাও কর ছাড়ের সুবিধা নিতে চাচ্ছেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কবিরুল ইজদানী বলেন, জিডিপির তুলনায় বাজেট ছোট। এর পরও রাজস্ব আয় কম থাকায় বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশ-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। রাজস্ব সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। এ থেকে উত্তরণে করনীতি সংস্কার করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অফিস কক্ষে বসে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি না করে জনগণের কাছে যেতে হবে। যাতে তারা কর দিতে উৎসাহী হয়। তাদের বোঝাতে হবে কর না দিলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে।
র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. এম আবু ইউসুফের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও অংশ নেন এনবিআরের সদস্য মাহমুদুর রহমান, ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভী ও সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশিদুল ইসলাম।