সম্পাদক

আবদুর রহমান

স্টাফ রিপোর্টার : উত্তরের আট জেলার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাট রুটে ফেরি সার্ভিস চালু করতে নেওয়া হয়েছিল একটি মেগা প্রকল্প। দুই দফায় প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয় বালাসী-বাহাদুরাবাদ ঘাটের দুই প্রান্তে দুটি টার্মিনাল। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটির কাজ শেষ হলেও বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদনে জানানো হয়, নাব্যতা সংকটের কারণে এই পথ ফেরি চলাচলের উপযোগী নয়।

দীর্ঘ ২২ বৎসর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের ৯ মার্চ গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বালাসীঘাট থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদঘাট নৌ-রুটে পরীক্ষামূলকভাবে লঞ্চ সার্ভিস চালু করে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। ফেরি সার্ভিসের পরিবর্তে লঞ্চ সার্ভিসের উদ্বোধন করা হলে সেটিও এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে সরকারের এ মেগা প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছেন না এই অঞ্চলের মানুষ।

নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ বালাসীঘাট-বাহাদুরাবাদ এই নৌরুট সচল রাখতে উভয় পাশে দুটি টার্মিনাল নির্মান করে। দুই পাড়ে নৌ টার্মিনাল দুটিতে নয়নাভিরাম অবকাঠামো এখন জনমানবহীন প্রান্তর-সদৃশ্য হয়ে আছে। এ প্রকল্পের আওতায় বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আধুনিক ডিজাইনের মসজিদ, খাবার হোটেল, আনসার ব্যারাকসহ বেশ কিছু নান্দনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।

পরীক্ষামূলক ভাবে এই রুটে লঞ্চ সার্ভিস চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন এই রুটে ৪টি ছোট লঞ্চ যাত্রী পারাপারে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলাচল করে। পরে নব্যতা সংকটে এখন চলছেনা লঞ্চ। তবে ১৪৫ কোটি টাকা খরচ করে এই রুটে লঞ্চ চলাচল কতটা যুক্তিযুক্ত তা এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

১৯৩৮ সালে তিস্তামুখ ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট চালু হয়। এ দুই ঘাটে ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ চালু ছিল। ১৯৯০ সালে নদীর নাব্যতা সংকটের অজুহাতে তিস্তামুখ ঘাটটি স্থানান্তর করা হয় একই উপজেলার উজানে বালাসীতে। নতুন করে সেখানেও ব্যায় করা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা। নির্মাণ করা হয় ত্রিমোহিনী রেলস্টেশন থেকে বালাসীঘাট পর্যন্ত নতুন প্রায় ৬ কিলোমিটার রেলপথ। সেখানেও কয়েক বছর চলার পর যমুনায় নাব্য হ্রাসের কারণে বালাসী-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পর ২০০০ সাল থেকে পুরোপুরি এ রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হতো এই অঞ্চলের মানুষ।

বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে বিকল্প পথ তৈরি করার যুক্তি দেখিয়ে ২০১৪ সালে বালাসী ও বাহাদুরাবাদে ফেরিঘাট চালুর লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে একনেকের সভায় বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটটি আবারও চালু করতে ফেরিঘাট নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

পরে দুই দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটি হঠাৎ করে নাব্য সংকট ও ২৬ কিলোমিটার বিশাল দূরত্বের নৌপথসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে নৌরুটটি চলাচলের অনুপযোগী বলে ঘোষণা করে।

বালাসীঘটে নৌকার জন্য অপেক্ষারত রংপুরের বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, আমি ময়মনসিংহে চাকরি করি। আমরা আগে নিরাপদে এই নৌরুটে পারাপার হইতাম ফেরীতে করে। বর্তমানে কয়েকটি ছোট লঞ্চ চলাচল করলেও সেগুলো নদীতে পানি কম থাকায় বন্ধ হয়ে আছে। আর এই কারনে আমাদেরকে নৌকায় জীবনের ঝুকি নিয়ে এই নদী পার হতে হয়।

কথা হয় স্থানীয় ইউপি সদস্য হামিদ মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন,বালাসীঘাট থেকে নদীপথে ফেরি সার্ভিস চালু হলে এ এলাকায় বেকারত্বের হার কমে যেত।এই এলাকায় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতো।

এই ব্যাপারে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জিএম সেলিম পারভেজ বলেন, এই নৌরুটটি একসময় উত্তরবঙ্গের ৮ জেলার মানুষ ব্যবহার করতো। প্রতিদিন এই বালাশীঘাটে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটতো। স্বল্প সময়ে মানুষ ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা,গাজীপুর জেলাসহ রাজধানী ঢাকায় যাওয়ার জন্য এই নৌরুটটি ব্যবহার করতো।

তিনি বলেন, চলতি বছরের মার্চে এই নৌরুটে পরীক্ষামূলক ভাবে ছোট কয়েকটি লঞ্চ চলাচল শুরু করে। নদীতে চর ভেষে ওঠায় লঞ্চগুলো আর চলাচল করতে পারছেনা। তবে এই নৌরুটটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যদি দেখা হতো তাহলে এই নৌরুটটি ব্যবহার করে মানুষজন দ্রুত তাদের গন্তব্যে পৌছাতে পারবে।

গাইবান্ধা লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মেহেদী হাসান জানান,চলতি বছরে প্রাথমিকভাবে লঞ্চ সার্ভিস চালু করা হলেও নাব্য সংকটের কারণে নদীপথে ডুবোচরে মাঝে মধ্যে লঞ্চ আটকা পড়ছে। এখন পুরোপুরি লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ায় যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। তবে বিআইডব্লিউটিএরচারটি ড্রেজার মেশিন সব সময় নদী খননের কাজে নিয়োজিত থাকার কথা থাকলেও এখন কাজ করছে একটি।

গাইবান্ধার বালাসীঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে গত তিন সপ্তাহ ধরে অবস্থানরত বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বালাসী-বাহাদুরাবাদ লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক করতে সরেজমিনে সমীক্ষা চালাচ্ছেন। কিভাবে বন্ধ এই নৌ-রুট স্বচল করা য়ায় সেব্যাপারে স্থানীয় জেলা প্রশাসনসহ লঞ্চ মালিক সমিতির সাথে একাধিকবার বৈঠকও করেছেন এবং বিভিন্ন প্রস্তাবনাও দাখিল করেছেন। এব্যাপারে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলেন, উর্ধতন কতৃপক্ষ ছাড়া আমরা কেউই এব্যাপারে মন্তব্য করতে পারবো না।