স্টাফ রিপোর্টারঃ
আট বছরের সাগর। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় সে। পড়ছে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। অভাব আর অনটনে ভালো চিকিৎসা করতে না পারায় মাস দুয়েক আগে মারা গেছে বৃদ্ধ বাবা আব্দুল খালেক। মা শন্তুভান ছোট ছোট ৪ সন্তানের আহার জোটাতে পেশা বেঁছে নিয়েছেন কৃষি শ্রমিক হিসেবে। তিস্তার চরাঞ্চলে নারী শ্রমের যোগান বেশি হওয়ায় মালিকরা নেন মজুরি কমের সুযোগ, দেন ১৫০-২০০টাকা। কাজও করতে হয় নাকি সকাল ৬টা-আসরের আযান পর্যন্ত। এছাড়া মৌসুম শেষ হলে কাজও পান না নিয়মিত। ফুলপেট, আধাপেট কখন ও বা উপোষ করে কাটাতে হয় সাগরসহ চার শিশুসন্তানকে নিয়ে। ভাবনায় পড়ে যায় ছোট্ট সাগর। কিছু একটা করতে হবে তাকে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর এবং কুড়িগ্রামের উলিপুরের সীমান্ত ঘেঁষা চরে ভুট্টা, আলুসহ নানান ফসল লাগিয়েছে কৃষকেরা। ওই ফসলের ক্ষেতে গজিয়েছে বথুয়াসহ নানারকমের শাক। বুদ্ধি মাথায় আসে সাগরের। ভুট্টা ও আলুর ক্ষেত থেকে বথুয়া শাক তোলা শুরু করে সে।
শাক তোলা দেখে সাগরের সাথে শাক তোলায় যোগ দেয়- একই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া উকিল, রায়হান বাবু, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া নাহিদ, আরিফুল ও রাসেল। শাক তুলে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে দুর্গম চরাঞ্চল পাড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে সুন্দরগঞ্জের মীরগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসে সাগরসহ অন্য ৫ শিশু শিক্ষার্থী। পাঁচটি শাকের আঁটি ১০টাকা। কমদামে সতেজ বথুয়া পাওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্রেতারা। মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায় ওদের শাকের আঁটিগুলো। সেখানেই দেখা হয়ে যায় ওই শিশুদের সাথে প্রতিবেদকের। ছবি তোলা দেখে চোখ ছলছল হয়ে ওঠে সাগরের। চোখের ভাষায় কী যেন বোঝাতে চায় সে!
বিক্রি শেষ হওয়ায় খাজনা নিতে ওদের সামনে এসে হাজির হয় এক নারী। ছয় শিশুর কাছে খাজনা চায় জনপ্রতি ৫ টাকা।
সাগর শাক বিক্রি করেছে ৪০টাকা, আরিফুল ৪০টাকা, রায়হান কুড়ি টাকা এবং অন্যান্যরাও পায় প্রায় একই টাকা। এতো অল্প টাকা বিক্রি করে খাজনা দিতে হবে! জানা ছিলনা তাদের। পক্ষে কথা বলায় স্বস্তি পায় ওরা। যেতে বলতেই বাড়ির পথে পা বাড়ায় সবাই।
দুর্গম চরাঞ্চল পাড়ি দিয়ে ওদের জীবনযাপনের হালচাল দেখতে গেলে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি সাগরসহ অন্যান্য শিশুদের বাড়ি। ধুলিমাখা শরীরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল সাগর। দেখেই চিনতে পারে সে। বাইকের পিছনে উঠতে বলায়
খুশি হয় সাগর, নিয়ে যায় বাড়ি। দেখা যায়, বাড়িতে ছোট্ট একটি পাটখড়ির ওপরে পলিথিন
দিয়ে তৈরি একটি চালা ও তার সামনে চুলা।
সাগর জানায় তার শাক বিক্রির পিছনের সেই করুণ গল্প। সাগর রিপোর্ট একাত্তর কে বলে,
‘শাক বিক্রি করেছে ৪০টাকা। পনের টাকার ৩টি সিঙারা খেয়েছে। বাড়িতে ছোট ভাই রাসেল, বড় ভাই সোহেল এবং মা শন্তুভানের জন্য এনেছে ১৫টাকা দিয়ে ৩টি লাড্ডু। আর বাকি ১০টাকা দিয়েছে তার মমতাময়ী মায়ের হাতে।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া নাহিদ রিপোর্ট একাত্তর কে জানায়, তার মাও একজন কৃষি শ্রমিক। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ সে। জন্মের পরেই মাকে ছেড়ে পালিয়েছে বাবা আবুল কাশেম। বোনদের বিয়ে হওয়ায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ভাই জাহিদকে নিয়ে মায়ের কাছেই কাটছে ওদের জীবন।
ওদেরও দুচোখ ভরা স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্ন থেকেই কেউবা হতে চাইল ডাক্তার, কেউবা মাস্টার। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি পূরণ হবে সাগরদের?