ষ্টাফ রিপোর্টার:

নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথে ৩৪টি লেভেলক্রসিং। এর মধ্যে ২১টিই অবৈধ। বৈধ-অবৈধ এসব লেভেলক্রসিংয়ের কারণে প্রকৃত গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এ পথে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া লেভেলক্রসিংগুলোতে প্রতিদিন শতাধিকবার লোহার প্রতিবন্ধক বার ফেলা হয়। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী, পরিবহণ শ্রমিক ও পথচারীরা। এ রেলপথে আরও দুটি লাইন হচ্ছে। তখন ভোগান্তি আরও বাড়বে। রেলওয়ে বলছে, এসব লেভেলক্রসিংয়ে আন্ডারপাস বা ওভারপাস তৈরি হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা করছে না। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ বলছেন, ওভারপাস বা আন্ডারপাস নয়, মাটির নিচ দিয়ে রেললাইন নেওয়া হোক, ওটাই হবে প্রযুক্তিসম্পন্ন কাজ।

রেলওয়ের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান বলেন, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয়, চতুর্থ রেললাইন নির্মাণ হচ্ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ডাবল লাইন হচ্ছে। এ পথের লেভেলক্রসিংগুলোর অধিকাংশই অবৈধ। অবৈধগুলো সরাতে, বৈধগুলোতে আন্ডারপাস-ওভারপাস করতে যুগ যুগ ধরেই বলা হচ্ছে। আমাদের রেলে আন্ডারপাস কিংবা ওভারপাস করার অর্থ বা পর্যাপ্ত জমি নেই। লাইন ভেদ করে যে সংস্থাগুলোর রাস্তা তৈরি হয়, সেই সংস্থাগুলোই আন্ডারপাস বা ওভারপাস করার কথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। আমরা বহুবার লিখিতভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশন, এলজিইডি ও সওজকে জানিয়েছি আন্ডারপাস বা ওভারপাস তৈরি করতে। আমরা এটাও বলেছি, রেল থেকে জমি দেওয়াসহ যতটুকু সহযোগিতা প্রয়োজন, তা করা হবে। কিন্তু তারা করছে না।

তিনি আরও বলেন, সারা দেশেই অবৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে। রাজধানীরগুলোই সবচেয়ে উদ্বেগের। আমরা বারবার সংশ্লিষ্টদের বলছি, কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। সর্বশেষ ১৩টি লেভেলক্রসিংয়ে আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ করতে প্রাথমিক সমীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর লেভেলক্রসিংগুলোর আশপাশে পর্যাপ্ত জমি নেই। ফলে কোনো অবস্থাতেই এসব লেভেলক্রসিংয়ে আন্ডারপাস বা ওভারপাস করা সম্ভব নয়। আমরা বহুবার রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। ওনারা সব দায়দায়িত্ব অন্যের ওপর দিয়ে দিতে চাইছে। তিনি বলেন, রাজধানীর ওপর দিয়ে চলা লাইনগুলো আন্ডারপাস (মাটির নিচ দিয়ে রেললাইন) করা হলে সবচেয়ে কার্যকর হবে। খুব সহজেই এ কাজটি করা যাবে। জায়গাও কম লাগবে। প্রকৃত গতি নিয়ে ট্রেনগুলোও চলাচল করতে পারবে।

সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা সাফ জানিয়ে দিতে চাই, লাইন আন্ডারপাস বা ওভারপাস করা হোক। ওটাই হবে প্রযুক্তিসম্পন্ন উন্নয়ন কাজ। প্রতিটি লেভেলক্রসিং দিয়ে হাজার হাজার যান, পথচারী রাত দিন ২৪ ঘণ্টা চলাচল করছে। সবই মানুষের কল্যাণে তৈরি হয়েছে। এখানে অবৈধ বলতে কিছুই নেই।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত লেভেলক্রসিংগুলোতে বছরে ৫-৬টি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। একেকটি দুর্ঘটনায় প্রাণহানিসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু, রেল এসব দুর্ঘটনার দায়ভার নেয়নি। বরং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্রেন নিজ পথে চলে, লাইনচ্যুত হয়ে রাস্তায় গিয়ে কোনো যানবাহনে ধাক্কা দেয় না। যানবাহন লেভেলক্রসিং ভেদ করে ট্রেনে ধাক্কা দেয়। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহর লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে সড়ক যানের ধাক্কায় পাঁচজন নিহত হন। ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর টিটিপাড়া লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস সংঘর্ষে সাতজন এবং একই বছরের ৩০ এপ্রিল একই রকম দুর্ঘটনায় ছয়জন মারা যান।

২০২০ সালে টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথের ১৩টি লেভেলক্রসিংয়ে আন্ডারপাস এবং ওভারপাস করার একটি সমীক্ষা প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ে যুগ্ম-মহাপরিচালক (প্রকৌশল) মামুনুল ইসলাম বলেন, আমরা সর্বশেষ যে প্রাথমিক সমীক্ষা করেছি, সেখানে ১৩টি লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে সাতটিতে আন্ডারপাস এবং ছয়টিকে ওভারপাস করার জন্য কাজ করেছি। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে সমীক্ষাটি ঢাকা সিটি করপোরেশন, এলজিইডিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছি। এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দপ্তরগুলো। রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় ১২২ বার লেভেলক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক লোহার বার ফেলা হয়। গড়ে ৫ মিনিট করে বার ফেলা থাকলে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১০ ঘণ্টা বন্ধ থাকে ক্রসিংগুলো। মালবাহী ট্রেনের ক্ষেত্রে গড়ে ১০ থেকে ১২ মিনিট বন্ধ থাকে ক্রসিংগুলো। ওই সময় ক্রসিংয়ের দু’পাশে শত শত যানবাহন আটকে থাকে।