ষ্টাফ রিপোর্টার:

আর মাত্র তিন দিন বাদে অর্থাৎ আগামী ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল। দুই হাজারেরও বেশি অতিথি নিয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে।

উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী বক্তৃতা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টিকিট কেটে প্রথম যাত্রী হিসাবে ট্রেনে চড়বেন। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথম এ ট্রেনটি চালাবেন মরিয়ম আফিজা নামের একজন নারী চালক।

সেদিন প্রধানমন্ত্রী আগারগাঁও থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি পর্যন্ত মেট্রোরেলে ভ্রমণ করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, উদ্বোধনের পরদিন থেকে সাধারণ যাত্রীরা টিকিট কেটে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন। তবে উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়বেন রেলসংলগ্ন বাসিন্দারা।

প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে রেলসংলগ্ন বাসিন্দাদের প্রতি ৭ দফা নির্দেশনা জারি করেছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। নির্দেশনাগুলো হলো-এক. কোনো ভবন, বিল্ডিং বা ফ্ল্যাটে ২৯ ডিসেম্বরের আগে নতুন কোনো ভাড়াটিয়া উঠতে পারবেন না; দুই. কোনো ভবনের কমার্শিয়াল স্পেসে আগামী ২৮ ডিসেম্বর নতুন কোনো অফিস, দোকান, রেস্টুরেন্ট খোলা যাবে না; তিন. ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেল সংলগ্ন কোনো ভবনের বেলকনিতে, ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া যাবে না এবং কেউ দাঁড়াতে পারবেন না;

চার. ওইসব এলাকার ভবন, বিল্ডিং বা ফ্ল্যাটে ওইদিন কোনো ছবি বা ফেস্টুন লাগানো যাবে না; পাঁচ. মেট্রোরেল সংলগ্ন কোনো ভবনের কমার্শিয়াল স্পেসে বা আবাসিক হোটেলে ২৮ ডিসেম্বর কেউ অবস্থান করতে পারবে না; ছয়. ওই এলাকার কোনো ভবন বা ফ্ল্যাটে যদি কোনো বৈধ অস্ত্র থাকে, তা ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে থানায় জমা দিতে হবে এবং সাত. মেট্রোরেলের দুই পাশের সব ব্যাংক বা এটিএম বুথ ২৮ ডিসেম্বর সকাল থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলাকালে বন্ধ থাকবে।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এসএসএফ-এর পরামর্শক্রমেই এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলে পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে। তারপরও দেশের প্রথম মেট্রোরেল হিসাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যতটা বর্ণাঢ্য হওয়ার কথা ছিল, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তা সীমিত করা হয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই প্রথমদিকে মেট্রোরেলের যাত্রী সংখ্যা ধারণক্ষমতার চেয়ে কম থাকবে। পর্যায়ক্রমে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। উদ্বোধনের পর দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ট্রেনগুলো পূর্ণ যাত্রী নিয়ে চলবে। প্রাথমিক অবস্থায় সকালে কিছুক্ষণ, আবার বিকালে কিছুক্ষণ ট্রেন চলবে। তার মানে হলো ট্রেন চলাচলের সংখ্যা কম থাকবে; সূত্রমতে সে সংখ্যাটা হবে পাঁচ।

যাত্রীদের ওঠানামা ও আসনে বসা-এসব বিষয়ে অভ্যস্ত ও পরিচিত করাতে স্টেশনে ট্রেন কিছুটা বাড়তি সময় দাঁড়াবে। কিন্তু পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে এবং স্টেশনে দাঁড়ানোর সময় কমে আসবে। ট্রেনটি চলবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে। সে হিসাবে আগারগাঁও থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট। ধারণা করা হচ্ছে, পরে এ যাত্রার সময় ১৭ মিনিটে নেমে আসবে।

মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে ৬টি কোচ থাকবে। এর মধ্যে দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হয়ে থাকে ট্রেইলর কোচ যেখানে চালক ও ৪৮ জন যাত্রী থাকবেন। বাদবাকি চারটি কোচের প্রতিটিতে যাত্রী সংখ্যা হবে ৫৪ জন। সব মিলিয়ে একযাত্রায় একটি ট্রেন ৩০৬ জন যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে। ট্রেন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি চালু হলে প্রতিদিন সব ট্রেন প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করতে সক্ষম হবে। মেট্রোরেলের চারটি স্টেশনে যাত্রীরা চাইলে তাদের গাড়ি একেবারে ট্রেনের সিঁড়ি বা লিফটের কাছে নিয়ে আসতে পারবেন।

এছাড়া বাস, ট্যাক্সি কিংবা অটোরিকশার যাত্রীদের স্টেশনের খুব কাছাকাছি এসে নামার সুযোগ রাখা হয়েছে। স্টেশন প্লাজা নামের এ চারটি স্টেশন হলো-উত্তরা, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর। আগামী ২৯ ডিসেম্বর থেকে যাত্রীরা আপাতত প্রথম দুটি স্টেশনে প্লাজার সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। স্টেশনগুলোতে থাকবে আধুনিক সব সুবিধা। তিনতলা স্টেশনগুলোতে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা যাবে।

দ্বিতীয় তলাটি তৈরি করা হয়েছে অফিস ও টিকিট কাউন্টার হিসাবে, এটাকে বলা হয় কনকোর্স হল। এই দ্বিতীয় তলায় টিকিট কেটে যাত্রীরা চলে যাবেন তৃতীয় তলায় যেটা প্ল্যাটফরম হিসাবে ব্যবহৃত হবে; টিকিটবিহীন কোনো যাত্রী সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং ট্রেনের দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলবে এবং বন্ধ হবে।

মেট্রোরেলের ভাড়ার বিষয়টি কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব স্বল্প দূরত্বের জন্য সুবিধাজনক না হলেও বেশি দূরত্বের যাত্রীদের জন্য বেশ সাশ্রয়ী। এর তুলনা করা যেতে পারে বিকল্প পরিবহণ হিসাবে বাস, ট্যাক্সি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা সাধারণ রিকশার সঙ্গে। সরকার মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করেছে সর্বনিম্ন ২০ টাকা আর বর্তমানে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে সর্বনিম্ন ১০ টাকা।

সে হিসাবে যারা ২ কিংবা ৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে চান, তাদের কাছে মেট্রোরেলের ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি মনে হবে। কিন্তু মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল এই ২০ কিলোমিটারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। সেক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি গড় ভাড়া ৫ টাকা। যদি আপনি উত্তরা থেকে ট্যাক্সিক্যাবে মতিঝিল যেতে চান তাহলে ভাড়া গুনতে হবে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা; সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গেলে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা; আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চড়ে যেতে লাগবে ১৪০ টাকা।

তাছাড়া ঢাকায় এখন কোনো কোনো জায়গায় রিকশা যেতেই চায় না। আর গেলেও ২০ টাকার কম কোনো ভাড়া নেই। সুতরাং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মেট্রোরেলের ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা হয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু আজকের আলোচনায় মেট্রোরেলের যে অংশ বিবেচনা করা হয়েছে তা হলো, উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এ দূরত্বের ভাড়ার হিসাব হলো, উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ পর্যন্ত একই ভাড়া-২০ টাকা।

প্রথম স্টেশন থেকে মিরপুর পল্লবী ও মিরপুর-১১ স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা; মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়ার ভাড়া ৪০ টাকা; শেওড়াপাড়ার ভাড়া ৫০ টাকা এবং আগারগাঁওয়ের ভাড়া ৬০। যদি আপনি উত্তরা উত্তর থেকে ট্যাক্সিক্যাবে আগারগাঁও আসতে চান, তাহলে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা; আর যদি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আসেন, তাহলে ভাড়া গুনতে হবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সে হিসাবে মেট্রোরেলের ৬০ টাকা ভাড়াকে সাশ্রয়ীই বলতে হবে। প্রবেশপথ ও নির্গমনপথ কার্ড পাঞ্চ করে খুলতে হবে। সব মিলে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে।

ঢাকানগরী একটি অপরিকল্পিত শহর হিসাবেই গড়ে উঠেছে। এর ভেতরে চলাচলের জন্য যে যোগাযোগ অবকাঠামো, তা কোনোকালেই আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছিও ছিল না। এর পাশাপাশি আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামোগুলোকে অক্ষত রেখে একটি পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলাও প্রায় অসম্ভব। তারপরও বিদ্যমান পরিবহণ অবকাঠামোকে বহাল রেখেই চলে বিড়ম্বনা লাঘবের প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেয়।

জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি হয় ২০১৩ সালে। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ চলছে। এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম পর্বের কাজ, যা ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। প্রথম পর্বে এ অংশের দূরত্ব ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ অংশে ৯টি স্টেশন আছে; সেগুলো হলো-উত্তরা দিয়াবাড়ি, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁও।

এর বাইরে নির্মাণাধীন আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন হবে ৭টি; যেগুলো হলো-বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেস ক্লাব ও মতিঝিল। এ পর্বের কাজ আগামী বছরের শেষদিকে সম্পন্ন হওয়ার কথা এবং মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজ সম্পন্ন হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

আমাদের প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করার ক্ষেত্রে ত্রুটির পরিমাণ কমই লক্ষ করা যায়; কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় বাস্তবায়নে এবং প্রকল্পের ব্যয়ে স্বচ্ছতা ধরে রাখতে। প্রায় সব প্রকল্পেরই একটি সাধারণ সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না হওয়া এবং এ কারণে প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়।

মেট্রোরেল প্রকল্প যখন হাতে নেওয়া হয়, তখন এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পথ সম্প্রসারণ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণ, কিছু স্টেশনে নতুন করে জমি অধিগ্রহণ, পরামর্শকের পেছনে ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়তি ভ্যাটসহ বিভিন্ন কারণে ব্যয় বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হয়েছে। সাধারণত যে কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হেরফের হওয়াকে আমরা স্বাভাবিক বলেই বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু মেট্রোরেল প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ। ২২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এ টাকার মধ্যে জাইকা দেবে ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা আর বাংলাদেশ সরকারের ভাগে পড়েছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।

এ রকম জমকালো প্রকল্পের একটি সমস্যা বোধকরি রয়েই গেল। সাধারণত সারা বিশ্বে এ ধরনের প্রকল্পগুলো হয় একটি পরিবহণ ব্যবস্থার সমন্বিত অংশ হিসাবে। কিন্তু আমরা প্রকল্পটি সমাধা করার চেষ্টা করেছি একটি পৃথক প্রকল্প হিসাবে। সেক্ষেত্রে স্টেশন সংযোগকারী সড়কগুলোতে যানবাহণের চাপ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সব সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার পরেও ঢাকার মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবহণ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করছি বলে আশা ব্যাক্ত করেন মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।