নিউজ ডেস্ক :
দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড সোমালিল্যান্ডে কার্যক্রম প্রসারিত করে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলটিকে একটি প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করছে। এতে বাণিজ্যিক সক্ষমতাহীন সোমালিল্যান্ডের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে।
দুটি নতুন ক্রেন এক বিশাল কার্গো জাহাজের উপর সারিবদ্ধভাবে রাখা কন্টেইনারগুলো সহজেই নামাতে পারে। আর কন্টেইনারগুলো বহন করার জন্য ট্রাকগুলো সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করে। এটি সোমালিল্যান্ডে নবনির্মিত বারবেরা বন্দরের দৃশ্য।
সংস্কারের পর ২০২১ সালে বন্দরের টার্মিনাল সুবিধা পুনরায় চালু করার পর থেকে বারবেরা টার্মিনালে শিফট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোহামেদ আতে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ধীর গতিতে চলা ক্রেনগুলো পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
কিছু দিন আগেও বড় জাহাজ থেকে কন্টেইনার আনলোড করা বিপজ্জনক ছিল বলে তিনি জানান। কারণ, তখন ডক শ্রমিকদের জাহাজের নিজস্ব ক্রেন ব্যবহার করতে হত।
তিনি বলেন, নতুন ক্রেন ও সংস্কার কাজের পর বন্দরের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। “চার বছর আগে ঘণ্টায় মাত্র সাতটি কন্টেইনার নামানো যেত। এখন এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০টিতে। ফলে আপনি বড় ধরনের পার্থক্য দেখতে পাচ্ছেন,” ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি।
সংস্কারের আগে বারবেরা বন্দর বছরে দেড় লাখ ২০-ফুটের কন্টেইনার হ্যান্ডেল বা পরিচালনা করতে পারতো। বর্তমানে এর সক্ষমতা চারগুণ বেড়েছে, ভবিষ্যতে যা ১৩ গুণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বিনিয়োগ ও চাকরি আকৃষ্ট করতে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল
বারবেরা পোর্টের সম্প্রসারণে দুবাইভিত্তিক বহুজাতিক লজিস্টিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড অর্থায়ন করেছে। কার্গো লজিস্টিকস, বন্দর অপারেশন, সামুদ্রিক পরিষেবা এবং মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এই কোম্পানির ৩৪টি দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম রয়েছে, যার ১২টি হচ্ছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে।
৪৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪১৬ মিলিয়ন ইউরো) বিনিয়োগের বিনিময়ে ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দরটি পরিচালনা করবে।
প্রথম পর্যায়ের সম্প্রসারণ শেষে ডিপি ওয়ার্ল্ড বর্তমানে দ্বিতীয় ধাপের সম্প্রসারণের আওতায় ১০০ মিটারের নতুন জেটি নির্মাণ ছাড়াও ক্রেন চলাচলের জন্য সাতটি পথ তৈরি করছে।
উপরন্তু, কোম্পানিটি বিনিয়োগ এবং চাকরি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বারবেরা অর্থনৈতিক অঞ্চল নামে এক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল স্থাপন করেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত না হলেও ১৯৯১ সালে সোমালিয়া থেকে বের হয়ে আসার পর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করে আসছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে চুক্তি তাদের স্বীকৃতি অর্জনে কাজ করবে বলে ধারণা করা হয়।
বারবেরা খুব কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে
নিজ অফিস থেকে সুপাচাই ওয়াত্তানাভিরাচাই সারিবদ্ধ কন্টেইনার ও নতুন জেটি ভালভাবেই দেখতে পান। পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যে ডিপি ওয়ার্ল্ডের ম্যানেজার থাইল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী সুপাচাই এখন বারবেরা বন্দরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
তিনি বিশ্বাস করেন, হর্ন অফ আফ্রিকার আশেপাশের অঞ্চল একটি অগ্রগতির অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। এই অঞ্চলে শুধুমাত্র ইথিওপিয়ার জনসংখ্যাই ১০ কোটির বেশি।
“ইথিওপিয়া একটি ল্যান্ডলক বা স্থলবেষ্টিত দেশ। প্রয়োজনীয় সরবরাহের জন্য দেশটির একাধিক গেটওয়ে থাকা দরকার। সেদিক থেকে সোমালিল্যান্ড বেশ কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। বারবেরা থেকে আদ্দিস আবাবার দূরত্ব ৯০০ কিলোমিটার, জিবুতির দূরত্বও তেমনই,” ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি।
সুপাচাই জানান, জিবুতি হর্ন অফ আফ্রিকায় অবস্থিত ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র যার দক্ষিণে সোমালিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমে ইথিওপিয়া এবং উত্তরে ইরিত্রিয়ার সাথে সীমান্ত রয়েছে। ইথিওপিয়ার প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্য বর্তমানে জিবুতির বন্দরের মধ্য দিয়ে হয়।
ডিপি ওয়ার্ল্ড ম্যানেজার নিশ্চিত যে, বারবেরা পোর্ট প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে সোমালিল্যান্ড ও এর জনগণের জন্য সুবিধার বয়ে আনবে। “আমরা মুনাফা করতে চাই, দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই মুনাফা। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন চারপাশের সবাই উপকৃত হয় আর তাহলে তারা আমাদের সমর্থন করবে,” তিনি বলেন।
তিনি জানান, ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিনিয়োগ গত পাঁচ থেকে ছয় বছরে স্থানীয়দের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সুবিধা এনেছে, যার মধ্যে দুই হাজার ৭০০টি চাকরি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
দুই-তৃতীয়াংশ পণ্য ইথিওপিয়ার দিকে যাচ্ছে
বারবেরার বাইরে কয়েক মাইল দূরে জোসেফ ওগুটা ডিপি ওয়ার্ল্ড কর্তৃক উন্নত একটি এলাকা দেখান যা বারবেরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে। ২০২৩ সালের শুরুতে চালু হতে যাওয়া মুক্ত বাণিজ্য এলাকার প্রধান হিসেবে কাজ করবেন এই কেনিয়ান।
সেখানে ব্যবসা স্থাপনে ইচ্ছুক কোম্পানিগুলোকে করপোরেট কর থেকে অব্যাহতি, পণ্যের শুল্কমুক্ত সংরক্ষণ, আমদানি বা রপ্তানির অনুমতিপত্র থেকে অব্যাহতি এবং বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের সক্ষমতাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হবে।
“এখানে যাই আসুক না কেন তা হবে করমুক্ত। যদি পণ্য রপ্তানির জন্য যায়, তবে অবশ্যই কোন কর থাকবে না। তবে, যদি এটি স্থানীয় বাজারে যায়, তবে আমদানিকারককে কর দিতে হবে,” ওগুটা বলেন।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের অনুমান, বারবেরা বন্দরের মাধ্যমে প্রেরিত গম, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, মেশিন এবং নির্মাণ সামগ্রীর দুই-তৃতীয়াংশ যাবে ইথিওপিয়ার দিকে। কারণ, বিনিয়োগের তুলনায় ৪২ লাখ জনসংখ্যার সোমালিল্যান্ডের খুব ছোট একটি বাজার বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
জটিল রাজনীতির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মে ডারউইচ বলেন, প্রতিবেশীদের জন্য সামুদ্রিক গেটওয়ে হওয়া সোমালিল্যান্ডের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। হর্ন অফ আফ্রিকায় অবকাঠামোগত বিনিয়োগের উপর তার গবেষণার অংশ হিসাবে তিনি সম্প্রতি জিবুতি এবং বারবেরা সফর করেন।
“এটা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। সোমালিল্যান্ড সরকার কাস্টমসের মাধ্যমে তার আয়ের বেশিরভাগ অর্জন করে যা তুলে নেওয়ায় তারা বড় ধরনের রাজস্ব হারাবে। বিনিময়ে কিছু উন্নয়ন, বাণিজ্য, বিনিয়োগকারী আসবে বলে তাদের প্রত্যাশা। তাই আমি মনে করি, এই একটি আশার কথা মাত্র,” ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি।
শুরুতে ইথিওপিয়া এই প্রকল্পের ১৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু টাইগ্রে অঞ্চলের যুদ্ধ দেশটিকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। কভিড-১৯ মহামারির কারনণ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে ইথিওপিয়ার দুর্দশাকে আরও বেড়ে যায়। ফলে ইথিওপিয়া তার শেয়ার ছেড়ে দেয়। তাই ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং সোমালিল্যান্ড এই প্রকল্পের শেয়ারহোল্ডার, যেখানে ৩৫ শতাংশ সোমালিল্যান্ডের আর বাকি ৬৫ শতাংশ ডিপি ওয়ার্ল্ডের।
তবে সোমালিল্যান্ডের বন্দর ও বাণিজ্য অঞ্চল প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী অর্থমন্ত্রী সাদ আলি শিরে আশাবাদী যে, ডিপি ওয়ার্ল্ডের বিনিয়োগে উন্নত বন্দর এবং এর ব্যবহারের মাধ্যমে অর্জিত রাজস্ব সোমালিল্যান্ডের জন্য ভাল ফল আনতে পরে।