
সম্পাদক
লেখক: জিএম তালুকদার
আবুল ভাই পেশায় একজন ছোটখাটো দর্জি। লুঙ্গি, মশারি, পর্দার কাপড়, বালিশের কভার এই জাতীয় সেলাই কাজ করে। সেলাই মেশিনটা ও অনেক পুরনো টেবিলের উপর সেট করে পায়ে চাপ দিয়ে চালাতে হয়।
বর্তমান সমাজে একেবারেই নিম্ন আয়ের একজন মানুষ। তার দুটি ছেলে বাচ্চা, বড় টার বয়স ১১ আর ছোটটার বয়স ৪ বছরের একটু বেশি হবে। আবুল ভাই ও তার বউ ছোট বাচ্চাটিকে আদর করে নাম রেখেছেন বিন্দু।বড় ছেলেটার নাম রবি।সে প্রাইমারি স্কুলে যায় কারণ বই পত্র, বেতন এখন পর্যন্ত বিনামূল্য। ছোট একটি বাঁশের চাটাইয়ে ঘেরা টিনের দোচালা ঘরে তাদের আবাসন, সামনে একটু জলাশয় থাকায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস লাগে।
দক্ষিণ পাশে একেবারেই সীমানায় লাগানো বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব মোহন সাহেবের বাড়ি, একসময় বড় চাকরি করতেন এখন অবসরে আছেন ঢাকায় থাকেন বিভিন্ন উপলক্ষে ঈদ পার্বণে বাড়িতে আসেন , এবারেও ঈদে বাড়িতে এসেছেন ,তারই ধারাবাহিকতায় বড় আকারের একজোড়া ষাঁড় গরু কিনেছেন কুরবানী করবেন।
একেবারেই পাশের বাড়ি হওয়াতে অবুঝ বিন্দু একটু পরে পরেই কোরবানীর ষাঁড় দেখতে যায়। ফিরে এসে তার বাবা-মায়ের সাথে ষাঁড়ের গল্প করে এই বলে যে,
কালো গরুটার শিং অনেক লম্বা আর লালটা সারাদিন শুয়ে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিন্দু মাঝে মধ্যে হাতে করে সবুজ ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে যায় গরুর মুখে নিক্ষেপ করে। ফিরে এসে আবার মায়ের সাথে গল্প করে ঈদের গল্প, কোরবানীর গল্প, গরুর গল্প এই গল্পের যেন আর শেষ নেই।
বাচ্চাটি অনেক ছোট হলেও খোদা প্রদত্ত এই বুঝ যেন সে পেয়েছে তার বাবার কুরবানী দেওয়ার সামর্থ্য নেই। কেননা তারা গরিব মানুষ দিন আনে দিন খায় কোনরকমে সংসার চলে। আবুল ভাই গরিব হলেও নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে খুব সতর্ক থাকে, কারো কাছে কিছু চেয়ে খাওয়ার অভ্যাস তার একেবারেই নেই।
পরের দিন ঈদ তাই আবুল ভাই বাজার থেকে একটি হাঁস কিনে নিয়ে এসে রাখল ঈদের দিন জবাই করবে।
ছোট ছেলে বিন্দু বাবাকে জিজ্ঞেস করে বাবা হাস জবাই করলে কি কোরবানী হবে?
উত্তরে বাবা বললো হবে।
রাত পোহাল যথারীতি সবাই ঈদগাঁয় নামাজ পড়তে গেল বিন্দুর বাবাও দুই ছেলেকে নিয়ে গিয়ে নামাজ পড়ল। নামাজ শেষে আবুল তার বউকে হাঁসটি জবাই করে রান্না করতে বললো এই বলে বিছানায় ঘুমাতে গেল। ঐদিন বোধহয় তাদের বাবার ঘুম একটু বেশিই এসেছিল ,লম্বা ঘুম।
ছোট্ট অবুঝ শিশু বিন্দু কেউ কিছু বোঝে উঠার আগেই এক দৌড়ে মোহন সাহেবের বাড়িতে গরু জবাইয়ের দৃশ্য দেখতে গেল।
অনেক লোক মিলে গরু জবাই করল বিন্দু দূর থেকে সব দেখল আবার দৌড়ে গিয়ে তার মাকে সংবাদ দিল গরু জবাই করে ফেলেছে। অবুঝ বিন্দু একটু পরে পরেই ওই বাড়িতে আসা যাওয়া করতে শুরু করলো । এদিকে গোশত কাটার দৃশ্য দেখে দৌড়ে এসে মাকে এটা ওঠা বলে, এদিকে ওর বাবার ঘুম যেন আর ভাঙছেই না ,অনেক গভীর ঘুম।
গোশত কাটার ভিড়ে বিন্দু এক কোণে বসে থাকে, এক সময় বিন্দু বুঝতে পারে সব গোশত থেকে গরিবের গোশত আলাদা করা হচ্ছে ,ওইখান থেকে গরিবদের গোশত দেওয়া হবে।
বিন্দু এক দৌড়ে এসে তার মাকে বলল মা এখন গরিবদের গোশত দিবে। বাচ্চার মুখে এই বার্তা শুনে মায়ের মুখ আড়াল করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বড় ছেলে রবিকে ডেকে আস্তে আস্তে বলে এই খালইটা(পানিতে মাছ রাখার বাঁশের পাত্র) নিয়ে যা তোর বাবার শোনলে রাগ করবে যদি মাংস দেয় চুপি চুপি নিয়ে আসবি। মায়ের কথায় রবি রাজী হল খালইটা হাতে নিয়ে রওনা হল পিছে পিছে বিন্দুও রওনা হল। মোহন সাহেবের বাড়িতে গিয়ে দেখে গরীব মানুষের লম্বা লাইন।
এত মানুষের ভিড়ে রবির মুখটি লাল হয়ে গেল তবু মাথা নিচু করে লম্বা লাইনে দাঁড়ালো রবির হাত ধরে বিন্দুও খালি হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। গরিবের গোশত দেওয়া শুরু হলো -ছোট একটি বাটিতে করে বড়জোর ০৩ টুকরা গোশত হবে এক জনের ভাগে। দুই ভাই মিলে একজনের পরিমাণ ০৩ টুকরা গোশতই পেল অবশ্য বিন্দুর হাতেও যদি আরেকটি পাত্র থাকতো তাহলে হয়তো আরো ০৩ টুকরা পেত তাহলে মোট ০৬ টুকরা হত তা আর হয়নি।
যাহোক ০৩ টুকরা গোশতই নিয়ে দুই ভাই মায়ের কাছে গেল, মা এটা দেখে চোখ মুছতে একটু আড়াল হতে চাইলো রবি সেটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল! ছোট্ট শিশু বিন্দুও ঘর থেকে বের হয়ে হাতে কয়েকটি বড়ই বিচি নিয়ে মোহন সাহেবের বাড়ির দেওয়ালে ছুঁড়তে ছিল। মা জিজ্ঞেস করল বিন্দু কি করো ? বাচ্চাটি উত্তর দিল মা আমি খেলা করছি।
বিন্দুর মা এই ০৩ টুকরা গোশত ০৬ টুকরা করে সাথে বেশি পরিমাণ আলু মিশিয়ে কোনরকমে একটি ছোট পাতিলে রান্না করার চেষ্টা করে হয়তো কিছুটা সফল হল। বিন্দুর নানা বাড়ি খুব কাছে হওয়াতে সন্ধ্যায় বিন্দুর নানা তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলো। বৃদ্ধ তার মেয়েকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বারান্দায় মুচলায় নামাজে দাঁড়ালো, নামাজ শেষে কিছুক্ষণ পরে সবাই মিলে ঘরের মেঝেতে খেতে বসলো। বিন্দু তার নানাকে বলল, নানা জানো? আমরা হাঁস কুরবানী দিয়েছি।
বিন্দুর মা খাবার পরিবেশন শুরু করল এইভাবে যে–এক পিসকে দুই পিস করা ০৬ টুকরা গোশতের আলু মিশানো তরকারি একটি বাটিতে আর হাঁসের গোশত অন্য একটি বাটিতে রেখে দিল।
বিন্দুসহ এই চারজনের খাবারে ০২ টুকরা দিল নানাকে, ০২ টুকরা বাবাকে, ০১ টুকরা রবিকে আর ০১ টুকরা বিন্দুর পাতে।
বিন্দুর বাবা জিজ্ঞাসা করল গরুর গোসত কোথা থেকে পেলে?
উত্তরে বিন্দুর মা বলল পাশের বাড়ি থেকে পাঠিয়ে ছিল, তৎক্ষণাৎ বিন্দু বলে বসলো না বাবা আমরা গিয়ে নিয়ে এসেছি। বিন্দুর কথা শুনে মুহূর্তেই পরিবেশটা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল এ যেন এক মর্মান্তিক নীরবতা।
ঈদের পরের দিন ঠিক দুপুরবেলায় বিন্দুর বাবা ঠেলা জাল আর একটা পাতিল নিয়ে বিন্দুকে সঙ্গে করে মাছ ধরতে যাবে স্থির করল। এমন সময় মোহন সাহেবের বাড়ি থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি এমনকি ধমকের শব্দ আসছিলো ।বিষয়টি আবুল প্রথমে বুঝে উঠতে পারে নাই পড়ে জানতে পারে গতকালের দেয়া কুরবানীর গোশত আনুমানিক চার মন প্যাকেটে করে ডিপ ফ্রিজে রাখা হয়েছিল ঢাকা নেওয়ার উদ্দেশ্যে, কিন্তু বারবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ফ্রিজের সাথে বিদ্যুৎ সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সারাদিন রাত পার হওয়ায় অতি গরমে গরুর গোশত দুর্গন্ধ ছড়ায় এক কথায় পচন ধরে।
শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে বাড়ির সামনে দুটি পুকুরের একটিতে পাঙ্গাসের চাষ করা হয় ওই পুকুরে গোশতের প্যাকেট গুলি যখন ফেলা হচ্ছিল ঠিক ওই সময়ে বিন্দু তার বাবার কাঁধে উঠে মাছ ধরতে যাচ্ছিল।
বিন্দু এই চিত্র দেখে চিৎকার করে বাবাকে বলতে লাগলো বাবা ওই দেখো গতকালের অনেক গোসত এখানে কি করছে? দেখো বাবা দেখো! পানি লাল হয়ে যাচ্ছে! মাছগুলো সব গোশত খেয়ে ফেলছে !দেখো বাবা! দেখো! দেখো!!
বাবা বললো দেখতে হবে না চলো আমরা মাছ ধরতে যাই। ছোট্ট শিশু বিন্দু চিৎকার করতে করতে বলতে লাগলো বাবা আমি আর মাছ ধরতে যাব না, আমি মাছ খাব না, আমার ভালো লাগছে না, আমাকে নামিয়ে দাও ,আমি বাড়ি চলে যাব।
শিশুটির তীব্র চিৎকার ও আকুতিতে আবুল আর ঐদিন মাছ ধরতে যেতে এই বাচ্চাটিকে রাজি করাতে পারে নাই! বিন্দু বাবার কাঁধ থেকে নেমে দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল।
বিন্দু তার মায়ের কাছে গিয়ে মাকে কি বলেছিল সেটা তার মা জানে আর পরম করুনাময় আল্লাহই ভালো জানেন ,কারণ শিশুটির ওই কথাগুলো আর কেউ শুনতে পায় নাই।
বিঃদ্রঃ (আমার স্বরচিত এই ঘটনাটি বাস্তব হলেও চরিত্রগুলো কাল্পনিক)
পাঠিয়েছেন: মোঃ সিদ্দিকুর রহমান ইমন, স্টাফ রিপোর্টার