নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি চায় জাপান। সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্যে বাংলাদেশ উৎস বহুমুখী করতে চাইছে।
এক্ষেত্রে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য মোবাইল রাডার বিক্রি করতে চায় জাপান। ঢাকায় জাপানের বিদায়ি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি শনিবার এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেন, বাজেট সহায়তার জন্য বাংলাদেশ জাপানের কাছে অর্থ চেয়েছে। জাপান এটা বিবেচনা করছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তার সাম্প্রতিক বিতর্কিত মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জাপান সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে তার প্রত্যাশার কথা তিনি বলেছেন। তারা আগের চেয়ে ভালো নির্বাচন চান। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন সফরের অপেক্ষা তার সরকার করছে বলেও জানান নাওকি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২৯ নভেম্বর জাপান সফরে যাওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ সরকার সফরটি স্থগিত করেছে। সূত্রমতে, জাপানে কোভিড পরিস্থিতির অবনতি এবং দেশটিতে কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করায় সফর স্থগিত হয়। সফরের নতুন তারিখ কবে হবে সে বিষয়ে কেউ ধারণা দিতে পারছেন না। তবে জাপানের রাষ্ট্রদূত বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় তারা অনেক চুক্তির আশা করছেন।
বিশ্বকাপ ফুটবলে জয় পাওয়ায় খুশি জাপানের রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, জার্মানির বিরুদ্ধে আমাদের দল চমৎকার খেলেছে। প্রথম জায়ান্ট দলকে বধ করেছে জাপান। আশা করি, কোস্টারিকার বিরুদ্ধে ম্যাচেও ভালো করবে। তারপর নকআউট পর্যায়ে যাবে। এবার জাপান সেরা দলের কাতারে যাবে।
রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, জাপান ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আমাদের সহযোগিতার ভিত্তি খুবই মজবুত। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ জাপানকে বড় অংশীদার হিসাবে পছন্দ করায় আমি খুবই গর্বিত। জাপান বাংলাদেশে যে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প সম্পন্ন করেছে তার সূত্রপাত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাপান সফর করেছেন। যমুনা সেতু নির্মাণে সহযোগিতা চেয়েছিলেন তিনি। এটা ছিল জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা। আমরা আরও অনেক সেতু নির্মাণ করেছি যেমন রূপসা সেতু, কাঁচপুরে মেঘনা-গোমতী সেতু। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। অনেক অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ করে সেতু নির্মাণে সহায়তা করেছি। তারপর আরও অনেক প্রকল্প নিয়েছে জাপান। যেমন-সোনারগাঁও হোটেল, কাফকো সার কারখানা, কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণায় কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। অনেক স্বেচ্ছাসেবী গেছেন কৃষি ক্ষেত্রে। তারা নতুন নতুন প্রজাতি উদ্ভাবন করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৫০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতায় ২৭ কিংবা ২৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা করেছে জাপান। জাপানি সহায়তা বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ১০ গুণ বেড়েছে। ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে এটা হয়েছে।
জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প এটা বড় প্রকল্প। যমুনায় ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণের কাজ করছি। আমরা মেট্রোরেল প্রকল্পে সহায়তা করছি। আমরা শিল্পের বহুমুখী করছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহায়তা করছি। মহেশখালীতে মাতারবাড়ি প্রকল্প হচ্ছে। পরিবহণের প্রাণকেন্দ্র হবে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হলে এটি একটি পরিপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দর হবে যার প্রভাব আঞ্চলিক ক্ষেত্রে পড়বে। মাতারবাড়ি হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের গেম চেঞ্জার। তবে মাতারবাড়ি বঙ্গোপসাগরকে ছাপিয়ে গিয়ে প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধির হাব হবে। এটার কৌশলগত প্রভাবও রয়েছে।
বাংলাদেশ এ অঞ্চলের উন্নয়নে, আঞ্চলিক কানেকটিভিটি, আঞ্চলিক কূটনীতিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। মাতারবাড়ি এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে। মাতারবাড়ির কৌশলগত প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। তবে আমরা মাতারবাড়িকে সামরিক কাজে ব্যবহার করব না। আমরা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করব। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, তারপর বন্দরের সম্প্রসারণ হবে এনার্জি এলপিজি টার্মিনাল। কনটেইনার ফ্যাসিলিটি হবে। এটা চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি বাড়াবে। মাতারবাড়ি প্রকল্প পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হবে। ২০২৪ সালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু করবে। তারপর কনটেইনার এয়ার ও এনার্জি টার্মিনাল হবে।
দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হবে এই দশকের শেষ নাগাদ। আজ থেকে ১০-১৫ বছর পর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হবে। এটা আমাদের প্রত্যাশা। তাই মাতারবাড়িকে অগ্রাধিকারে নেওয়া প্রয়োজন। এ প্রকল্প জিডিপির ওপর কী প্রভাব ফেলবে তার গবেষণা দরকার। নতুন করে মহাপরিকল্পনা করতে হবে। পুরো মাতারবাড়ি প্রকল্পে কত ব্যয় হবে তা আমরা এখনও জানি না। প্রাথমিকভাবে আমরা মনে করছি, গোটা মাতারবাড়ি প্রকল্পে ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর কেন স্থগিত হলো জানতে চাইলে ইতো নাওকি বলেন, আমরা দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে কাজ করছি। তবে কত তাড়াতাড়ি হবে সেটা আমরা জানি না। সফর স্থগিত হওয়ার কারণ জাপানের কোনো অভ্যন্তরীণ কারণে হয়েছে এমন কিছু দেখছি না। বাংলাদেশের তরফে কোনো আপত্তি দেখছি না। তবে আমরা উভয় দেশ এখন সফরটি দ্রুত করতে চাইছি। সফরকালে আমরা অনেক সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এ সফর সম্পন্ন হলে আমরা অংশীদারত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হবো। এ সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো নিরাপত্তা সহায়তা। আমাদের দুই দেশের মধ্যে কর্মকর্তাদের সফর বিনিময় কর্মসূচি রয়েছে।
জাপানের প্রতিরক্ষা জাহাজ বাংলাদেশ বন্দরে সফর করেছে। শুভেচ্ছা অনুশীলনও হয়েছে। এসব সামরিক সহযোগিতা আমরা এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছি। আমরা বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে চাই। বাংলাদেশ এখন প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনার উৎস বহুমুখী করছে। বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী কিনবে তার অন্যতম জাপান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তার একটা সরঞ্জাম হলো, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য জাপানি কোম্পানির তৈরি মোবাইল রাডার সিস্টেম কেনা। আশা করি, এটা বাস্তবায়ন হবে। এখন আমরা প্রাথমিক আলাপ-আলোচনা করছি। আমাদের এ ব্যাপারে কিছু প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে হবে। জাপান থেকে একটি যৌথ মিশন শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে। আমরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে নিরাপত্তা সহায়তা দলিল সই করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য ক্ষেত্রে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং অর্থনৈতিক অংশীদরিত্ব চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে সামনে এগিয়ে নিতে জাপান অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি করতে চায়। এর মাধ্যমে অধিকতর বাজার সুবিধা, সেবার বাণিজ্য, মেধাসত্ত্ব, আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে নিয়মকানুন নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। এসবের মাধ্যমে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বাড়াবে। দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে হবে সাপ্লাই চেইন। এ ছাড়া কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণে জাপানি কোম্পানি কাজ করতে চায়। বাংলাদেশ সম্ভবত তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে আগ্রহী হবে। সফরের তারিখ নির্ধারণ হলে সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়তে পারে।
জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা আমাদের অংশীদারত্ব নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। গত ৮ বছরে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বেড়েছে। এ দেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির ব্যাপারে জয়েন্ট স্টাডি হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে। বাংলাদেশ স্থিতিশীল আছে। বাংলাদেশের নীতির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা আছে। এ অঞ্চলে বাংলাদেশ বিস্তৃত ভূমিকা পালন করছে। আমাদের অংশীদারত্ব কৌশলগত মাত্রায় নিয়ে যেতে পারব। এটা বাংলাদেশের উন্নতির কারণে সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে আগের রাতে ভোট হয়ে যায় বলে বিতর্কিত মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে জাপানের বিদায়ি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, আমি আমার নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি মোটেও এ দেশের সমালোচনা করিনি। আমি আমার মতামত দিয়েছি। আগামী জাতীয় নির্বাচন অপেক্ষাকৃত ভালো হবে এই প্রত্যাশা করেছি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। এটা আমাদের জোরালো আশা ও প্রত্যাশা। আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক এটা আমরা চাই। আমি শুধু আমার আশা ও প্রত্যাশার কথা বলেছি। এটাই একমাত্র বিষয় যা আমি জোর দিতে চাই। বাংলাদেশ সরকার ও নির্বাচন কমিশন তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত ভালো নির্বাচন করবে এটা আশা করি।
তিনি বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন করা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠান জোরদার করা গুরুত্বপূর্ণ। এ দেশের জনসংখ্যা এই দেশের জন্য ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশের জন্য তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। তরুণ জনগোষ্ঠী তথা মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠান জোরদারে জাপান সহায়তা করবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবিক কাজ করেছে। এখন পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ সরকার ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে তা আমরা অনুধাবন করতে পারি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। জাপান এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে বার্তা পাঠিয়েছে। এই পরিবেশ সৃষ্টিতে সময় লাগবে। আমরা তহবিল দিচ্ছি। এই তহবিল প্রদান অব্যাহত রাখব।
ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকার তৃতীয় বছরের মতো বাজেট সহায়তা চেয়েছে। ২৪ মাসে ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিতে চেয়েছে আইএমএফ। আমরাও অনুরূপভাবে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সহায়তা দেওয়ার কথা বিবেচনায় রেখেছি।
তিনি বলেন, আমি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নতি চাই। বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সমর্থ হবে। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন জার্নিতে জাপান পাশে থাকবে। জাতির পিতার সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।