ষ্টাফ রিপোর্টার:

ছুটিতে থাকা অবস্থায় ভূমি দলিল করেছেন। নিজস্ব তহবিলের অর্ধকোটি টাকা খরচে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের কথা বলে নিয়েছেন দুই বছরের শিক্ষা ছুটি। যুক্তরাজ্যে পড়তে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে না গিয়ে সপরিবারে পাড়ি দেন অস্ট্রেলিয়া। দুই বছরের ছুটি শেষে দেশে এসে চাকরিতে যোগদানের কথা থাকলেও ফিরেছেন তিন বছর পর। এর মধ্যেই তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। এ অবস্থায় অতিগোপনে দেশে ফিরে উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে স্বপদে ফিরতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এমন সব কাণ্ড-কীর্তি চালিয়ে যাচ্ছেন নিবন্ধন অধিদপ্তরে সংযুক্তির আদেশপ্রাপ্ত গাজীপুর জেলার সদর সাবরেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম। নিবন্ধন অধিদপ্তর ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত নথিপত্রের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায় চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।

এদিকে, ৫ ডিসেম্বর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৬ থেকে এসব কাণ্ডের জন্য মনিরুল ইসলামের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। সিনিয়র সহকারী সচিব মো. শফিউল আলমের সই করা তলবি চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সংযুক্তির পর নিবন্ধন অধিদপ্তরে যোগদান না করা; কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে দেশত্যাগ; অননুমোদিতভাবে বিদেশে অবস্থান; যা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ২(খ) ও ২(চ) অনুযায়ী যথাক্রমে ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’-এর পর্যায়ভুক্ত বিধায় কেন আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না, তার ব্যাখ্যা পত্র প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে দাখিল করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শহীদুল আলম ঝিনুক বলেন, ‘আমার জানা মতে তিনি (মনিরুল ইসলাম) এখনো যোগদান করেননি। যোগদানপত্র জমা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব। যেহেতু আইন মন্ত্রণালয় তার নিয়োগ কর্তৃপক্ষ, সেহেতু তার ব্যাপারে এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলতে পারব না।’

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি মনিরুল ইসলামের কর্মকাণ্ড নিয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গাজীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রার থাকাবস্থায় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই যুক্তরাজ্যের কোভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে পড়ার জন্য দুই বছরের শিক্ষা ছুটির আবেদন করেন মনিরুল ইসলাম। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১ আগস্ট থেকে তার দুই বছরের শিক্ষা ছুটি মঞ্জুর করে আইন মন্ত্রণালয়। সে মোতাবেক তিনি ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে ছিলেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই বছরের ছুটি মঞ্জুর হলেও তিনি নির্ধারিত সময়ে ছুটিতে না গিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে আরও এক মাস অফিস করেন এবং অসংখ্য দলিল রেজিস্ট্রেশন করেন। অভিযোগ আছে, জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে এসব ভূমি রেজিস্ট্রেশন করে তিনি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন। এছাড়া সরকারি জমিও (বনভূমি) তিনি ব্যক্তিমালিকানায় রেজিস্ট্রেশন করে দেন। ছুটিতে থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকটি জাল দলিল করেন তিনি। যেগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা করা হয়। এ অবস্থায় তিনি ছুটিতে যান। তার এসব কর্মকাণ্ডে তখন গাজীপুরে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

নিবন্ধন অধিদপ্তরের একাধিক সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য তিনি শিক্ষা ছুটি নিলেও সেখানে না গিয়ে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করে পরিবারের সদস্যদের স্থায়ী করেন। দুই বছর পর ই-মেইল করে মন্ত্রণালয়ে আরও এক বছর ছুটি বাড়ানোর আবেদন করেন তিনি। কিন্তু মন্ত্রণালয় এই আবেদন গ্রহণ করেনি। এদিকে, দুদক সূত্রে জানা যায়, দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-২ থেকে গত ১৯ জানুয়ারি নিবন্ধন অধিদপ্তরে চিঠি দিয়ে এই কর্মকর্তা শিক্ষা ছুটি শেষে দেশে ফিরেছেন কি না, তা জানতে চাওয়া হলে হইচই শুরু হয়। দুদকের ওই চিঠিতে মনিরুল ইসলামের স্থায়ী, অস্থায়ী এবং তার বিদেশে অবস্থানের ঠিকানাও জানতে চাওয়া হয়।

মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া মনিরুল ইসলামের ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, ছুটি মঞ্জুরের প্রজ্ঞাপনে ভিসাপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ছুটি কার্যকর মর্মে কোনো শর্ত ছিল না। এরপরও অধিদপ্তর ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক চিঠির (স্মারক নং ১৭৯) আদেশে তাকে নিবন্ধন অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর তার অফিসিয়াল আন্তর্জাতিক মেশিন রিডিবল পাসপোর্ট করার অনুমতি দেওয়া হয়। তার ব্যক্তিগত নথিতে অধিদপ্তরে সংযুক্ত হয়ে যোগদানপত্র জমা দিয়েছেন এবং তা গৃহীত হয়েছে-এমন কোনো নোট বা আদেশ নেই। অধ্যয়নের জন্য বিদেশ যাওয়ার জন্য তাকে অবমুক্ত করা হয়-এমন কোনো তথ্যও নেই। তার শিক্ষা ছুটির সঙ্গে আবেদনের সংযুক্ত কথিত কোভেন্ট্রি ইউনিভার্সিটি কর্তৃক কোনোরূপ সুপারিশ ব্যতিরেকে মেইলযোগে শিক্ষা ছুটি এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেন।

আইন মন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা যায়, জালজালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি রেজিস্ট্রেশনের অভিযোগে মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে গাজীপুরের কাশিমপুর থানায় মামলা রয়েছে। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর (স্মারক নং-৪৭৩৩) এই মামলায় চার্জশিট দাখিলের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি পাঠিয়ে অনুমতি চায় পুলিশ। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা থেকে গত ১৪ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে চার্জশিট দাখিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপরই তাকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।

অনুসন্ধানকালে নিবন্ধন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে কাশিমপুর থানার মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেন মনিরুল ইসলাম। অতিগোপনে জামিন নেওয়ার পরই মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে স্বপদে যোগদানের চেষ্টা করছেন। কয়েকদিন আগে তিনি নিবন্ধন মহাপরিদর্শকের সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করতে যান। নিবন্ধন মহাপরিদর্শক তার সঙ্গে কথা না বলে তাকে রুম থেকে বের করে দেন।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি নিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে মনিরুল ইসলাম সম্পর্কে পাঠানো আরেক নোটে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের কথা বলে তিনি ছুটি নিয়েছেন, সেখানে তার শিক্ষা বৃত্তি ছিল না। সম্পূর্ণ নিজ খরচে তাকে পড়তে হবে। তাতে দুই বছরে তার ন্যূনতম খরচ হবে ৫১ হাজার পাউন্ড। তখনকার সময়ে বাংলাদেশি টাকায় যার অঙ্ক দাঁড়ায় ৫১ লাখ টাকা। সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরি করে এত টাকার সংস্থান তিনি কীভাবে করলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এছাড়া তিনি ছুটিতে থাকা অবস্থায় এক মাস যেসব দলিল রেজিস্ট্রি করেছেন, সেগুলোর আইনি বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে নোট শিটে উল্লেখ করা হয়।

নিবন্ধন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘ওপেন সিক্রেট’ আলোচনা আছে, মনিরুল ইসলাম আদৌ যুক্তরাজ্যের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাননি। শিক্ষা ছুটির অপব্যবহার করে তিনি সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। সেখানে তার বাড়িসহ ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। তিন বছর সেখানে অবস্থান করে স্ত্রী-সন্তানদের রেখে সম্প্রতি দেশে ফিরে তিনি ফের স্বপদে যোগদান করতে চাচ্ছেন। কারণ, সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরি করে বিপুল অবৈধ অর্থ আয়ের সুযোগ রয়েছে, যা অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে তার পক্ষে কামানো অসম্ভব।

এসব বিষয়ে জানতে এক সপ্তাহ চেষ্টা চালিয়েও ঢাকায় তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে ফেরার পর তিনি সবাইকে এড়িয়ে চলছেন। কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। অনেক চেষ্টার পর পাওয়া তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে।