ষ্টাফ রিপোর্টার:

বিমানের স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়া (ভিআরএস) কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে।

কথা ছিল-যারা স্বেচ্ছায় অবসরে যাবেন, তাদের নির্দিষ্ট হারের অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা দেওয়া হবে।

পাশাপাশি বিধি মোতাবেক প্রাপ্য পূর্ণ সুবিধাও (অবসরজনিত) পাবেন। এর মধ্যে বোনাস, মেডিকেল ভাতা, টিকিট প্রভৃতি ছিল।

এরপর বিমানের কর্মীদের মধ্যে আগ্রহীরা এই প্রস্তাবে সম্মত হন। এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিও হয়। কিন্তু দীর্ঘ ১৬ বছর কেটে গেলেও বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের এই সুবিধা দিচ্ছে না। সুবিধাগুলো আদায়ের জন্য তারা বিমানের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী মারাও গেছেন। অনেকে অসুস্থ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্তু সহস্রাধিক অসহায় সাবেক সহকর্মীর কথা শুনছেন না বিমান কর্তৃপক্ষ।

বিমান কর্তৃপক্ষ বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সার্কুলারের কারণে তাদের এই প্রস্তাব মানা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ চুক্তির পরই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, ভিআরএসপ্রাপ্তদের কেউ এই সুবিধা পাবেন না।

জানা যায়, ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিমানকে কোম্পানিতে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে বিমানের জনবল ৩৪০০তে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়। এজন্য ওই বছরের ৪ জুন স্বেচ্ছা অবসরে যেতে আগ্রহী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিমানের প্রেসক্রাইবড ফর্মে আবেদন করতে বলা হয়। আবেদনকারীদের ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে স্বেচ্ছা অবসর কার্যকর হবে বলে জানানো হয়।

বিমানের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যারা স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করবেন তাদের বিধি মোতাবেক প্রাপ্য পূর্ণ সুবিধা দেওয়া হবে। এছাড়াও ২৫ বছর চাকরির মেয়াদ সম্পন্নকারীদের মতো পেনশনের ওপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ আর্থিক সুবিধা পাবেন। সেসময় ১৮৬২ জন আবেদন করেন। তাদের সবাই স্বেচ্ছায় অবসরে যান। তাদের মধ্যে মারা গেছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। অসুস্থ হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই। বাকি সহস্রাধিক ঘুরছেন প্রাপ্য আদায়ের আশায়। কিন্তু কেউ কিছুই পাচ্ছেন না।

কবির উদ্দিন হায়দার নামে সাবেক যোগাযোগ কর্মকর্তা ও তৎকালীন বিমান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জানান, তারা ওই বিজ্ঞপ্তি অনুসারে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেও বিমান তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

তৎকালীন স্টেশন ম্যানেজার (প্যারিস) আব্দুল হালিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিজ্ঞপ্তিতে প্রদত্ত শর্তানুসারে বিধি মোতাবেক প্রাপ্য পেনশনের ওপর ১৫ শতাংশ আর্থিক সুবিধা তারা পেয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী তাদের অসরকালীন পেনশনের পূর্ণ সুবিধা দেওয়া করা হচ্ছে না। এর মধ্যে রয়েছে মাসিক মেডিকেল ভাতা, বার্ষিক উৎসব ভাতা ও বিধি মোতাবেক প্রাপ্য প্যাসেজ বা রিবেট টিকিট সুবিধা। ১৬ বছর ধরে তারা এই সুবিধা পেতে বিমানের দ্বারে দ্বারে ঘুরলেও কেউ কর্ণপাত করছেন না।

এ বিষয়ে বিমানের যোগাযোগ বিভাগের সাবেক জুনিয়র কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা ফয়সাল হোসেন তালুকদারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ভিআরএস বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী বিমান কর্তৃপক্ষ আমাদের স্বেচ্ছা অবসর অফার করলে আমরা তা গ্রহণ করি। এরপর উভয় পক্ষ একটা কন্ট্রাক্টে আবদ্ধ হই। আমরা কন্ট্রাক্ট গ্রহণ করার পরই কর্তৃপক্ষ তা কার্যকর করে। এরপর বিমান থেকে নতুন করে কোনো শর্ত আরোপ করার সুযোগ নেই। এটা হলে ব্রিচ অব কন্ট্রাক্টের পর্যায়ে পড়ে। এমন শর্ত আগে জানালে আমরা কখনোই ভিআরএসে যেতাম না। তিনি আরও বলেন, ৩ বছর ধরে মারাÍক অসুস্থ অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছি। বিমান আমাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে।

বিমান শ্রমিক লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার গোলাম কবির ভুইয়া বলেন, বিমান কর্তৃপক্ষ আমাদের ওপর চরম অন্যায় করেছে। আমাদের হক কেড়ে নিয়েছে। ২৫ বছর চাকরি করার পর ন্যায্য অধিকার পাব না, এটা মেনে নিতে পারছি না। মৃত্যুর পরও আমাদের দাবি থাকবে যাতে আমাদের সন্তানদের এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

জানা যায়, বিমানের বিরুদ্ধে এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় ২০০৭ সালে ভিআরএস-এর মাধ্যমে অবসর প্রদানকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব কর্মীর চাকরি বহাল আছে মর্মে রায় দেন আদালত। পরবর্তী সময়ে একশর বেশি কর্মী চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু তারপরও ভিআরএস পাওয়া কর্মীদের ন্যায্য দাবি পূরণ করেনি বিমান।

বিমান সূত্রে জানা যায়, চাকরির মেয়াদ ২৫ বছরের কম, ভিআরএস-এর নামে চাকরি হারিয়েছেন-এমন কর্মীর সংখ্যা ৪৩২ জন। এমন একাধিক কর্মী বলেন, বিমানের চাকরি বিধিমালার ১১(১) ধারা অনুযায়ী ২৫ বছর পূর্ণ না হলে চাকরি থেকে অবসর নেওয়া বা দেওয়া যায় না। কিন্তু বিমান এই বিধিমালা লঙ্ঘন করেছে, যা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।

বিমানকে কোম্পানি করার আগে ২০০৭ সালের জুনে ভিআরএস কর্মসূচির আওতায় প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৮৬২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়। ভুক্তভোগীরা তখনই অভিযোগ করেছিলেন, তারা কেউ স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়েননি। তাদের বাধ্য করা হয়েছে। এসব কর্মীর অনেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছেও একই অভিযোগ তুলে চাকরি ফিরে পাওয়ার আবেদন করেছিলেন। এরপর ১ হাজার ১২৯ জন কর্মী চাকরি ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করেন।

জানা যায়, হাইকোর্ট এসংক্রান্ত রিটের নিষ্পত্তি করে রায় দেন। তাতে বিমানের অনুমোদিত জনবল কাঠামোর মধ্যে তখন যে ৬০৮টি শূন্য পদ ছিল, সেসব পদে রিট আবেদনকারীদের বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই নির্দেশ না মানায় বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) চার কর্মকর্তাকে তলব করেন আদালত। এরপর বিমানের পক্ষ থেকে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য সময় চাওয়া হয়। আদালত ৯৭ দিন সময় দেন। এরপর আরও এক দফা সময় নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিমান আদালতের নির্দেশ পুরোপুরি মানেনি। ৬০৮টি পদের মধ্যে মাত্র ১৬০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আদালত অবমাননার অভিযোগে বিমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আটটি আবেদন করেন ১৫০ জন কর্মী, যা এখন আদেশের অপেক্ষায় আছে।