বিজয় কর রতন, মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি:-
এখন হাওরের ভরা যৌবন। বর্ষা আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওর উত্তাল। যতদূর চোখ যায় শুধু অথই পানির ধারা। নীল আকাশের নিচে এমন দৃশ্য নিজ চোখে অবলোকন করতে এ সময়ে ভ্রমণ পিয়াসীরা ছুটে আসেন হাওরে। এবার কিশোরগঞ্জের হাওরে সে ভ্রমণ পিয়াসীদের দেখা মিলছে না। কিশোরগঞ্জের হাওর সমৃদ্ধ নিকলীর বেড়িবাঁধ, করচবন, করিমগঞ্জের বালিখলা, হাসানপুর সেতু, ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের আভুড়া সড়কে পর্যটকের ঢল নেই।
অন্যান্য বছর এ সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের দেখা মিলতো এসব স্পটে। কিন্তু এবার হাওরের পুরো দৃশ্যপটই পাল্টে গিয়েছে। জেলার চিরচেনা হাওরগুলো এখন পর্যটকশূন্য। ঘাটে বসে বেকার সময় কাটাচ্ছেন নৌকার মাঝিরা। হোটেল রেস্তোরাগুলোও মানুষশূন্য। অথচ ১৫ দিন আগেও এখানে ছিল শত শত মানুষের কোলাহল আর হৈচৈ। আর এখন সেখানে এখন শুধু নিরবতা আর নিস্তব্ধতা।
এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র-শনিবারও হাওর সুনসান নিরব। লাগাতার কারফিউ আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে পাল্টে গিয়েছে হাওরের চিরচেনা এ দৃশ্যপট। হাওরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ স্পিডবোট আর নৌকা। কিন্তু এখন পর্যটকের অপেক্ষায় অলস পরে থাকা স্পিডবোট আর নৌকার নেই কোন কদর।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে সহিংসতায় বর্ষার ভরা মৌসুমেও পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে হাওর এলাকা। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্পকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া নৌকা ও স্পিডবোটের মালিক কর্মচারীসহ হোটেল-রেস্তোরাঁ, রিসোর্টের মালিক ও শ্রমিকেরা।
হাওর গুলোতে বছরের ছয় মাস পানি থাকে, আর বাকি সময়টা থাকে শুকনা। তাই স্থানীয়রা বলেন, বর্ষায় নাও আর শুকনায় পাও। বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে অনেকটা কূলহীন সাগরের মতো। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা হিজলগাছ আর পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বর্ষায় যেন সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে পসরা সাজায় হাওর। একটি বড় নৌকার মাঝি ও মালিক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন।
তিনি জানান, প্রতি বর্ষাতেই পর্যটকের কথা চিন্তা করে নৌকাকে সুসজ্জিত করতে হয়। এবছরও নৌকা মেরামত ও সুসজ্জিত করতে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শুরুটা ভালো হলেও, দেশের এমন উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শেষটা ভালো যাচ্ছেনা। যে সময়টাতে পর্যটকে ভরপুর থাকার কথা, আর এখন প্রতিদিনের বাজার খরচও হচ্ছেনা।
নিকলী বেড়িবাঁধ এলাকার ঢেউরের বাড় ভাসমান হোটেলের কর্তৃপক্ষ জানান, এ সময়টাতে আমরা পর্যটকদের চাপে থাকি। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ঘুরতে আসে। আমাদের হোটেলটি নৌকায় ভাসমান। তাই হাওরে ঘুরতে ঘুরতে পর্যটকরা খেতেও পারেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এবছর লোকসানে পড়েছি। যেখানে প্রতিদিন ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় হতো। সেখানে আয় নেই বললেই চলে। এখনতো হোটেলের শ্রমিকদের বেতন দেয়াটাই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
কথা হয় নেত্রকোনা থেকে আসা পর্যটক রাফিউল হাদির সাথে। তিনি জানান, গতবছরও আমরা কয়েকজন বন্ধু এখানে বাইক চালিয়ে এসেছি। কিন্তু হাওরের পথে প্রবেশ করতেই পুরো পথ ছিল হাজার হাজার পর্যটকে মুখর। পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমাদের ঘাটে আসতেই সময় লেগেছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। অথচ আজকে মাত্র ১০ মিনিটেই সেখানে পৌঁছতে পেরেছি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ এক প্রকার ঘরবন্দি। সারাদেশে কারফিউ চলছে। মানুষের নিরাপত্তার বিষয় রয়েছে। জেলায় সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আশা করছি পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে হাওরের পর্যটনশিল্পেও গতি ফিরে আসবে।