সম্পাদক

আবদুর রহমান

নিউজ ডেস্ক:

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই তার বিদায় চাইলেও আইন ও সংবিধান অনুযায়ী তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার সুযোগ আছে কিনা, সেই প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে তারা অবশ্য বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর ‘আইন ও সংবিধানের’ বিষয়টিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। ফলে ‘জনআকাঙ্ক্ষার’ আলোকে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে সে পদে বসাতে চাইলেও’ সেটি অসম্ভবও কিছু নয়। যদিও সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি।

মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করলেও ‘তার পদত্যাগ কিংবা অপসারণের’ দাবির প্রশ্নে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।

বিএনপি দলীয়ভাবে সিনিয়র নেতাদের এ বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে মন্তব্য না করার পরামর্শ দিয়েছে আর জামায়াতে ইসলামী শুধু বলেছে ‘রাষ্ট্রপতি অসত্য বক্তব্য দিয়ে ওই পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন’। যদিও উভয় দলের নেতাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘রাষ্ট্রপতি সরে যাক এটি তারা চান কি-না’।

উল্লেখ্য, দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী তার লেখা এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোন দালিলিক প্রমাণ তার হাতে নেই’।

তার এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় মিছিল-সমাবেশ করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন তারা। সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার সমর্থক ও আওয়ামী লীগ বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির তীব্র সমালোচনা করে তার পদত্যাগ কিংবা তাকে সরিয়ে দেয়ার দাবি জানাচ্ছে।

গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর প্রথমে সেনাপ্রধান ও পরে রাষ্ট্রপতি জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন।

সোমবারের বিতর্কের পর বঙ্গভবন থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়, ‘মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে কোন বিতর্ক সৃষ্টি না করার জন্য রাষ্ট্রপতি সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।’

এখানে বলে রাখা দরকার, বাংলাদেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কিংবা বিদায় নেয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ঘটনার পর নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ওই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সামরিক আইন জারি করে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিলেন। ‌এরপর তিনি নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন।

৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে খন্দকার মোশতাক আহমদ ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেদিনই সামরিক অফিসারদের অনুরোধে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েম। পরে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন বিচারপতি সায়েম।

অন্যদিকে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ওইদিন প্রথমে পদত্যাগ করেছিলেন তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদ। এরপর জেনারেল এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন এবং নিজে পদত্যাগ করেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন।

বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করতে পারে। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সংসদ বাতিল করে দেয়ায় সেই সুযোগ আর নেই। আবার রাষ্ট্রপতি চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ করতে পারেন।

কিন্তু স্পিকার পদত্যাগ করেছেন এবং ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি উঠলেও সেটি সংবিধান অনুযায়ী হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে সংসদ। কিন্তু সেটি বাতিল করা হয়েছে। আবার তার পদত্যাগেরও সুযোগ নেই। সে কারণে সংবিধান ও আইনগতভাবে তাকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তবে স্বৈরাচারী সরকারের বিদায়ের পর সবকিছু তো সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। তাই নিয়ম বা সংবিধানের প্রশ্ন অবান্তর। বরং জনআকাঙ্ক্ষার আলোকে তাকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা সরকার চাইলে করতেই পারে।

এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে অনেকেই পদত্যাগ করেছেন।

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আন্দোলনের সাথে ছিলেন না কিংবা বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে অনেককেই তো সরকার সরে যেতে বলেছে। সেসব ক্ষেত্রে তো সংবিধান দেখা হয়নি। সুতরাং রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তা হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সবকিছুই বাতিল করা যেত, কিন্তু তা না করে কোনটি বাদ দেয়া হয়েছে- আবার কোনটি রাখা হয়েছে বলেই এই জটিল পরিস্থিতি সামনে এসেছে।

তিনি বলেন, সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। কিন্তু আবার সেটি পুরোপুরি অনুসরণও করা হচ্ছে না। সবমিলিয়ে একটি লিগ্যাল অ্যানার্কি বা আইনি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে। এর ফলে হয়তো অনেক কিছুই করতে হচ্ছে, যা নিয়ম মেনে হবে না।